প্রাচীন বাংলার পুন্ড্র সাম্রাজ্যের অংশঐতিহ্য মণ্ডিত শহর রাজশাহী। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন কারণে এই শহরটি প্রাচীন বাংলায় পরিচিত ছিল। বিখ্যাত সেন বংশের রাজা বিজয় সেনএর সময়ের রাজধানী বর্তমান রাজশাহী শহর থেকে মাত্র ৯ কিমি দূরে অবস্থিত ।
রাজশাহীর প্রাচীন নাম ছিল মহাকাল গড়। মধ্যযুগে নাম হয় রামপুর-বোয়ালিয়া । ১৫ শতকে এর নাম হয় রাজশাহী । ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসেও রাজশাহী নামক কোন জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নাই । অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু হিন্দু, মুসলিম, রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী। ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের মতে, ১৫ শতকে রাজশাহী অঞ্চল ছিল গৌড়ের মুসলিম সাম্রাজ্যের অংশ। সেই সময় ভাতুড়িয়ার জমিদার ছিলেন রাজা গণেশ । রাজা গণেশের মুসলমানদের বিজীত এলাকা আত্বসাত করা থেকেই রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়। তিনি আরোও বলেন, একইভাবে মুসলিম মসনদে আরোহণকারী হিন্দু রাজা শাহ বলে পরিগণিত হওয়াই রাজা থেকে রাজ এবং গৌড়ের শাহ নামের শাহ নিয়ে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে রাজশাহী। হিন্দু রাজ আর ফারসী শাহী এই শব্দ দুটির সমন্বয়ে উদ্ভব হয়েছে মিশ্রজাত শব্দটির। আরেক ইতিহাসবিদ বেভারিজ বলেন, নাম হিসেবে রাজশাহী রাজা গণেশের সময়কাল থেকে প্রাচিন এবং এর অবস্থান ছিল রাজা গণেষের জমিদারী ভাতুড়িয়া পরগনা থেকে অনেক দূরে। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করেন এই জেলার জন্য।
আবার অনেকেই নামকরণের এই ইতিহাসকে অস্বীকার করেন । তবে ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলার নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ সালে নবাব মুশির্দকুলী খান সমগ্র বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩ (তের)টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে ‘চাকলা রাজশাহী’ নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি এলাকা নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে প্রবাহিত পদ্মা বিধৌত ‘রাজশাহী চাকলা’ কে তিনি উত্তরে বতর্মান রাজশাহী ও দক্ষিণে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে অপর অংশ রাজশাহী নিজ চাকলা নামে অভিহিত করেন। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ-জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুশিদ কুলির একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি। যে জন্য নবাব তাকে রাজা উপাধী প্রদান করেন। দক্ষিণ চাকলা রাজশাহী নামে বিস্তৃত এলাকা যা সমগ্র রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে অবস্থিত ছিল, তা ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করেন। এই জমিদারী পরে নাটোরের রাণী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। রামজীবন প্রথম নাটোর রাজ ১৭৩০ সালে মারা গেলে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন। ১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী ভবানী দেবী রাণী ভবানী নামে উত্তরাধীকারী লাভ করেন। অনেকের মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের উপর প্রীতি বশত এই চাকলার নাম রাজশাহী করেন নবাব মুশিদকুলী খান। কিন্তু ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাণী ভবানীর দেয়া নাম রাজশাহী । অবশ্য মিঃ গ্রান্ট লিখেছেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
রাজশাহীতে সাম্য ও সূফী ইসলামের আগমন
ইসলাম প্রচারের কাজে এদেশে প্রচুরসংখ্যক আরব, ইরানি ও তুর্কি মুসলমান ও সুফি দরবেশের আবির্ভাব ঘটে। মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন জীবন বিধান হিসেবে বিশ্বের সব দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হতে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে (প্রাচীন বঙ্গদেশে) কবে সর্বপ্রথম কিভাবে ইসলামের প্রচার হলো তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও প্রাচিন বঙ্গদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রথম ইসলামের সাম্য ও মুক্তির সূফী বাণী প্রচার করেছিলেন যারা তাদের মধ্যে তুরকান শাহ (র.), শাহ মখদুম (র.) ও সৈয়দ নাসিরউদ্দীন শাহ্ আউলিয়া (নেকবাবা) (র.) এবং সৈয়দ জালাল উদ্দীন বোখারী (র.)প্রমূখ।
রাজশাহী অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম প্রচারকারী মহান সাধক শহীদ তুরকান শাহ (র.) ইরাকের বাগদাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানীর বংশধর ছিলেন। মূলত তুরকান শাহের মাধ্যমেই রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পূর্ণতা পায় শাহ মখদুম রূপোশ (র.)’র মাধ্যমে। তুরকান শাহ (র.) ছিলেন শাহ মখদুম রূপোশ (র.)’র অন্যতম প্রিয় শিষ্য। ১২৮৮ সালে তুরকান শাহ (র.) স্থানীয় হিন্দু জালেম শাসকদের সাথে যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। [১]
বাংলাদেশে আগমন
সে সময় বাংলার শাসক ছিলেন তুঘরিল খান। তুঘরিল খান দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ১২৭৮ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন তার পুত্র বোখরা খানকে সাথে নিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে বাংলাদেশে আসেন। [২]
তখন দিল্লী থেকে তুরকান শাহ সহ প্রায় তিন শতাধিক ইসলাম প্রচারক গিয়াসউদ্দীন বলবনের যুদ্ধযাত্রায় সঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তাদের মধ্যে শাহ মখদুম রূপোশের পরিবারও ছিলেন। তুঘরিল খান যুদ্ধে পরাজিত হন এবং তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। বোখরা খানকে বাংলার শাসক বানিয়ে গিয়াসউদ্দীন বলবন দিল্লী ফিরে যান। কিন্তু ইসলাম প্রচারকারীদল বাংলায় বসবাস করতে থাকেন।
রাজশাহীতে তুরকান শাহ (র.)
ইসলাম প্রচারকারীদলের অন্যতম ছিলেন শাহ মখদুম রূপোশ (র.)। তিনি নোয়াখালী অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে যাওয়ার আগে তার বিশ্বস্ত তুরকান শাহ (র.) এবং কতিপয় শিষ্যকে মহাকালহড় তথা বর্তমান রাজশাহী অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব প্রদান করেন। অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে তুরকান শাহ (র.) ও তার শিষ্যরা রাজশাহীতে আসেন। বর্তমান রাজশাহী শহরের দরগাহপাড়ায় এক গহীন জঙ্গলে আস্তানা স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
ইসলাম প্রচার ও যুদ্ধ
সেই সময় রাজশাহী অঞ্চলে প্রচুর দেও মূর্তি এবং যত্রতত্র মঠ মন্দির ছিলো। এসব জায়গায় নরবলী দেওয়ার মতো প্রথা প্রচলিত ছিলো। তখন অত্র অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন সামন্তরাজ কাপলিক তন্ত্রে বিশ্বাসী দুই ভাই। তাদের একজনের নাম হলো আংশুদেও চান্দভন্ডীও বর্মভোজ এবং অপর ভাই হলেন আংশুদেও খেজুর চান্দখড়্গ গুজ্জভোজ। তারা দুইজনেই প্রচন্ড অত্যাচারী এবং অহংকারী শাসক ছিলেন। প্রশাসন ব্যাবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ, অবিচার আর বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিলো। এমতাবস্থায় তুরকান শাহ এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের শান্তির বাণী প্রচার শুরু করেন। উন্নত চরিত্র আর মহানুভবতার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই লোকজন দলে দলে ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আসা শুরু করে। ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা এতই বাড়তে থাকে যে বিষয়টি শাসকচক্রের নজরে চলে আসে। সামন্তরাজ তুরকান শাহ (র.)কে নানা ভাবে বাধা দিতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই তার ধর্ম প্রচার থামাতে না পেরে তার বিরুদ্ধে একদল সেনা প্রেরণ করে। তুরকান শাহ (র.)এবং তার শিষ্যরা প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় যুদ্ধে জড়িয়ে যান। সেই অসম যুদ্ধে তুরকান শাহ (র.)পরাজিত হন এবং তাকে হত্যা করা হয়। তাকে রাজশাহী শহরে দরগাপাড়া এলাকায় সমাহিত করা হয়। তার মাজার অত্র এলাকায় এখনো সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। কথিত আছে তাঁর লাশ দেও রাজা সরাতে না পেরে হাতি দ্বারা সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এতেও ব্যর্থ হলে তাঁর শহীদ হবার স্থানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
শাহ মখদুম রূপোশ (র):
প্রিয় শিষ্য তুরকান শাহ (র) বির্ধমীদের হাতে শহীদ হলে শাহ মখদুম রূপোশ (র) রাজশাহীতে আগমন করেন। শাহ মখদুম রূপোশ (১২১৬-১৩৩১ খ্রিস্টাব্দ) বাংলার প্রথিতযশা সুফী সাধক এবং ধর্ম-প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ তথা রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামের সুমহান বানী প্রচার করেছিলেন। তার অনুপম ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। মূলত শাহ মখদুম (র)‘র মাধ্যমেই বরেন্দ্র এবং গৌড় অঞ্চলে ইসলামের শক্তিশালী বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয় ।
মাজার ও ওরস
তুরকান শাহ (র.)‘র মৃত্যুর বহু শতাব্দী পর তার কবর মাজারে পরিণত হয় এবং প্রতিবছর হিজরী সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখে তার মাজারে ওরস পালন করা হয়।
তথ্য সূত্র:
[১-৩] মোঃ আবুল, কাসেম। শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ)-যুগ মানস(২য় সংস্করণ)। শাহ মখদুম রূপোশ (রহঃ) দরগা এস্টেট,রাজশাহী।