আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী২৭ আগষ্ট, ২০১৭ ইং, লন্ডন, ২৬ আগস্ট, শনিবার, ২০১৭ দৈনিক ইত্তেফাক।

সাম্প্রতিক সমস্যার সাম্প্রদায়িক দিক
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আর লিখতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে হয় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে গিয়ে নত মস্তকে বলি, বঙ্গবন্ধু, আপনি তো একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে স্ত্রী- পুত্র, দশ বছরের শিশুপুত্র, পুত্রবধূদের নিয়ে আত্মাহুতি দিয়ে গেলেন। এখন এই আত্মাহুতির দানের বেয়াল্লিশ বছর পর একবার সমাধি থেকে উঠে এসে দেখুন, আপনার স্বপ্নের বাংলার আজ কী অবস্থা। গণতন্ত্র এখানে ধুঁকছে। সাম্প্রদায়িকতা বিড়াল থেকে আবার বাঘের রূপ ধারণ করেছে। আপনার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর জীবন বাজি রেখে অসাম্প্রদায়িক বাংলাকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারবেন কি? তাঁর ডাইনে শত্রু, বাঁয়ে শত্রু, সামনে শত্রু, পেছনে শত্রু। আপনি হাতে ধরে যাদের রাজনীতিতে এনেছেন, তাদের মধ্যেও বিভীষণদের সংখ্যা বাড়ছে। আপনার হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের ভেতরেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঢুকছে।
এই বিষবাষ্প সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতিতে তো বটেই, সমাজ দেহের সর্বত্র। নইলে সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনী-সম্পর্কিত আপিল আদালতের রায় এবং তার সঙ্গে যুক্ত প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যালোচনা নিয়ে যে বিতর্ক ও বিরোধ শুরু হয়েছে, তা আইনি বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সংবিধান ও আইন-বিশেষজ্ঞদের মতামত দ্বারা মীমাংসা করা উচিত। কিন্তু এটিকে একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে যে বাকযুদ্ধ শুরু করা হয়েছে এবং যদু মধু সবাই এই বাকযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের রাজনীতিকে ঘোলা করছে, তার পরিণতি কী হতে পারে, তা ভেবে দেখছে না।
এখন বাকযুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত। কিন্তু সমস্যাটির গায়ে সাম্প্রদায়িকতার রং চড়ানো হচ্ছে। আমার সন্দেহ, বিএনপি-জামায়াত শিবির সরকারকে ঘায়েল করার জন্য একদিকে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষার নামে মাঠে নেমে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তাঁর চরিত্রে সাম্প্রদায়িকতার রং ছিটিয়ে কৌশলে দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ও ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের বিরোধ বাধানোর চেষ্টা করছে। এটা আমার ধারণা তা আগেই বলেছি।
লন্ডনে বসে বিএনপি-জামায়াতিদের প্রচার-প্রচারণা দেখে এদের ড. জেকিল ও মি. হাইডের ভূমিকা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। আমার দুঃখ, আওয়ামী লীগের একশ্রেণির নেতা-কর্মী বিএনপি-জামায়াতের এই ডাবল গেম বুঝতে পারছেন না। বরং তাদের ট্র্যাপে পা দিচ্ছেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি মাননীয় সুরেন্দ্রকুমার সিনহা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় ষোড়শ সংশোধনী-সংক্রান্ত তাঁর রায় দানের পেছনে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং এই প্রথম একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদে বসানো ভুল হয়েছে বলে যে কানাঘুষা চালানো হচ্ছে, তা শুধু অনভিপ্রেত নয়, বিপজ্জনকও।
বিচারপতি সিনহা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক বলে তাঁকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছে, এটা ভুল বার্তা। তিনি নিজের যোগ্যতার বলেই প্রধান বিচারপতির পদে বসেছেন এবং তাঁকে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ সরকারই। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়টি তিনি একা দেননি। তাঁর প্যানেলের বিচারপতিদের অন্য সকলেই মুসলমান। সুতরাং তিনি সাম্প্রদায়িক বা অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এই রায় দিয়েছেন এই প্রচার কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ বিশ্বাস করবে না। ষোড়শ সংশোধনীর সঙ্গে যুক্ত প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণগুলোর কোনো কোনোটি অবশ্যই বিতর্কমূলক এবং রায়ের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক বলে অনেকেই মনে করেন।
এর প্রতিকার তো প্রধান বিচারপতির ধর্ম, বর্ণ, যোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে অসত্য প্রচারণা ও অশালীন মন্তব্য করা নয়। তাতে প্রধান বিচারপতির যে পদটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি অন্যতম ভিত্তি তার ক্ষতি করা হয়। এই ক্ষতি আসলে গণতন্ত্রের ক্ষতি। প্রধান বিচারপতির মন্তব্য সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে তার একটা আইনি সমাধান প্রয়োজন। সরকার এবং বিরোধী দলের যেসব নেতা-কর্মী এটা নিয়ে বাজারি খিস্তি-খেউর শুরু করেছেন, প্রধান বিচারপতির গায়ে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগাচ্ছেন, তাদের অনেকেই দেশের গণবিরোধী শিবিরের উদ্দেশ্য সাধনে জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে সাহায্য জোগাচ্ছেন।
বাংলাদেশের সামনে এখন কোরবানির ঈদ এবং দুর্গাপূজা। সাধারণত এ সময় সাম্প্রদায়িক চক্রগুলো দেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পূজামণ্ডপে হামলা চালায়, মূর্তি ভাঙে। সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি লুট করে। দেশে সাম্প্রদায়িক মৈত্রী রক্ষার জন্য হাসিনা সরকার অবশ্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলতে থাকলে এই উত্তেজনা থেকে অশান্তি অবশ্যই আবার দেখা দিতে পারে। প্রধান বিচারপতির ‘পর্যালোচনা’ নিয়ে যাতে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা প্রশ্রয় লাভ না করে এবং কোনো মহল ভারতীয় জুজুর ভয় সৃষ্টির সুযোগ না পায়, সরকারকে সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।
ভারতে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল ড. আবদুল কালামের মতো একজন মুসলমান বিজ্ঞানীকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছেন তা নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। শাদা বর্ণবাদীদের ঘাঁটি আমেরিকা ওবামার মতো একজন অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্টকে বরণ করে নিয়েছিলেন, গায়ের রং দিয়ে তার যোগ্যতাকে বিচার করা হয়নি। বরং দু’ দুবার তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং ছিলেন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগের মতো একটি অসাম্প্রদায়িক দল অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই সুরেন্দ্রকুমার সিনহাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়েছে। তার ধর্ম বর্ণ বিচার করে দেয়নি। তার যোগ্যতা বিচার করে দিয়েছে।
এখন যদি বিচারপতি হিসেবে তার কোনো “পর্যালোচনা” কারো কাছে গ্রহণযোগ্য মনে না হয়, তার প্রতিকার তো গালি নিন্দা করে এই ইনস্টিটিউশনটির মর্যাদাহানি করে হবে না, তার মীমাংসা হবে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত দ্বারা। প্রধান বিচারপতিও সেকথা বলছেন এবং প্রধানমন্ত্রীও সেই মীমাংসার পথ ধরেছেন। তিনি তাঁর উপদেষ্টা গওহর রিজভীকে সেই উদ্দেশ্যেই প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়েছেন এবং আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছেন। আমার ধারণা, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে এই বিরোধটিকে উসকে দিয়ে একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টির যে আশা গণবিরোধী মহল করছিল তা ব্যর্থ হওয়ায় এখন প্রধান বিচারপতির চরিত্রে সাম্প্রদায়িকতার রং চড়িয়ে এবং তার সঙ্গে “ভারতের যোগসূত্র” আবিষ্কার করে এই মহলটি দেশে অঘটন ঘটাতে চায়।
লন্ডনে বসে ফেসবুক খুললেই এই প্রচারণা। আমাকে এক বন্ধু বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত রয়েছে এই প্রচারণার পেছনে। আবার আওয়ামী লীগ সমর্থক বলে পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে যেসব কথা লেখা হচ্ছে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব কথা বলা হচ্ছে তাও কম ক্ষতিকর প্রচারণা নয়। ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের ইংরেজি তরজমা করেছেন ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক অথবা রায়টি পাকিস্তানের কোনো বিচারক দ্বারা লিখিত হয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে, এই ধরনের ঢালাও প্রচারণা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মোটেও উজ্জ্বল করছে না।
প্রশ্ন উঠবে আওয়ামী লীগ সরকার কি জেনেশুনে এমন একজন ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়েছেন, যিনি একটি রায় লিখতে সক্ষম নন? আর তাঁর সঙ্গে যে আরো বিচারপতিরা আছেন, তাঁরা কি চোখ বুজে অন্যের লেখা রায়ে সই দেবেন? এই প্রচারণা শুধু আমাদের বিচার বিভাগের নয়, গোটা রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর। ব্যক্তি-বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে দেশের এতো বড় ক্ষতি করা কোনো দেশপ্রেমিকের উচিত নয়। প্রধানমন্ত্রীর উচিত, দেশের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দলের বা সরকারের যদু মধুকেও মুখ খুলতে না দেওয়া। ফেসবুক, টুইটারে এসব প্রচারণা একেবারে বন্ধ করা না গেলেও এগুলো যে মিথ্যা তা জনগণকে ভালোভাবে জানানোর ব্যবস্থা করা।
বর্তমান পরিস্থিতির শঙ্কাজনক দিক জানা সত্ত্বেও আমাদের সুশীল সমাজের অনেকেরই পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিস্ময়কর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যান্য দলের নেতাদের নীরব ভূমিকা। এই রাজনৈতিক সংকট এবং তাকে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির কাজে লাগানোর অপচেষ্টা রোধে তাদের কি কোনোই দায়িত্ব নেই? মন্ত্রিত্ব রক্ষা এবং সরকারের চাটুকারিতাই কি তাদের একমাত্র কাজ? এই বিরোধ সাংবিধানিকভাবে মেটানো এবং এই সমস্যাকে সাম্প্রদায়িকতার রং লাগিয়ে একটি বা একাধিক অশুভ চক্র যাতে কাজে লাগাতে না পারে, সেজন্য মহাজোটের অন্তর্গত বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর কি কোনো দায়িত্বই নেই?
নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের এই বিরোধ মীমাংসায় সকলকেই আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এই ধরনের বিরোধ ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতেও ঘটে, তাকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা হয় না। এটা আদপেই রাজনৈতিক ইস্যু নয়, সাংবিধানিক ইস্যু, সংবিধানের নির্দেশের আলোকেই এর মীমাংসা করতে হবে। প্রধান বিচারপতিকে একথা অবহিত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকেও।
এই বিরোধটির সুযোগ নিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারকে তা অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। একেই বন্যা সমস্যা দেশে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গে আরেকটি সমস্যা যেন যুক্ত না হয়। সামনে ঈদ-উল-আজহা এবং দুর্গাপূজা। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই যাতে শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে এই উত্সব পালন করতে পারে, কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার-প্রচারণা দ্বারা কোনো ধরনের অশান্তি দেখা না দেয় সেদিকে সকলের নজর রাখা উচিত।